অনলাইন ডেস্ক: গেলো মাসে (এপ্রিল) বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম ছুঁয়েছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ শিখর, যার ধাক্কা লেগেছে বাংলাদেশও। মূল্যস্ফীতি, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা আর বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার জেরে বিনিয়োগকারীরা ছুটছেন ‘নিরাপদ স্বর্ণের’ দিকে। এমন প্রেক্ষাপটে দেশের বাজারেও স্বর্ণের দাম পৌঁছেছে নতুন রেকর্ডে। ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি ভরি এখন ১ লাখ ৭২ হাজার টাকারও বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন প্রশাসনের কাছ থেকে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের আশা এবং ডলারের শক্তিশালী অবস্থান স্বর্ণের দামের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। ইউবিএস বিশ্লেষক জিওভান্নি স্টাউনোভো মন্তব্য করেছেন, ‘বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা এবং শক্তিশালী ডলার স্বর্ণের ওপর প্রভাব ফেলছে।’
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম ইতোমধ্যে চলতি বছরে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফেডারেল রিজার্ভ যদি সুদের হার কমায় এবং বাণিজ্য উত্তেজনা বাড়ে, তাহলে দাম ৩ হাজার ৫০০ ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ববাজারে স্পট স্বর্ণের দাম একপর্যায়ে প্রতি আউন্সে ৩ হাজার ৫০০ ডলার ছুঁয়ে ফেললেও শুক্রবার (২ মে) পতনের পর বর্তমানে ৩ হাজার ২৩৫ ডলারে অবস্থান করছে। যা ১৫ এপ্রিলের পর থেকে সর্বনিম্ন। একই সময়ে, মার্কিন স্বর্ণের ফিউচারও ২.৭ শতাংশ কমে ৩ হাজার ২৩০.৮০ ডলার হয়েছে। এদিকে ডলার ইনডেক্স ০.৩ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার ফলে ডলার-মূলক স্বর্ণ আন্তর্জাতিক বাজারে আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে, স্পট সিলভার এর দাম ১.৮ শতাংশ কমে প্রতি আউন্স দাঁড়িয়েছে ৩১.৯৯ ডলারে, প্লাটিনাম ১ শতাংশ হ্রাস পেয়ে হয়েছে ৯৫৬.৬৩ ডলার এবং প্যালাডিয়াম ০.৩ শতাংশ বেড়ে ৯৪১.১০ ডলার।
দেশের বাজারে কত দামে বিক্রি হচ্ছে স্বর্ণ
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) সর্বশেষ যে দাম নির্ধারণ করেছে, সে অনুযায়ী দেশব্যাপী স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে নতুন দামে। এর আগে ২৩ এপ্রিল বাজুস এক বিজ্ঞপ্তিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বর্ণের দাম কমিয়েছিল। এবার ২২ ক্যারেট স্বর্ণের এক ভরিতে ৫ হাজার ৩৪২ টাকা কমিয়েছে সংগঠনটি।
হালনাগাদ স্বর্ণের দাম নতুন মূল্যতালিকা অনুযায়ী, ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম প্রতি ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৪৬ টাকা। ২১ ক্যারেট স্বর্ণের দাম প্রতি ভরি ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬৯৬ টাকা। ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের দাম প্রতি ভরি ১ লাখ ৪১ হাজার ১৬৯ টাকা। সনাতন পদ্ধতি স্বর্ণের দাম প্রতি ভরি ১ লাখ ১৬ ৭৮০ টাকা।
ভ্যাট ও মজুরি সংক্রান্ত তথ্য: বাজুসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, স্বর্ণের বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে সরকার নির্ধারিত ৫ শতাংশ ভ্যাট ও ন্যূনতম ৬ শতাংশ মজুরি যোগ করতে হবে। তবে গহনার ডিজাইন ও মানভেদে মজুরি ভিন্ন হতে পারে।
পুরনো দাম কত ছিল: ২২ এপ্রিল সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধির সময় বাজুস ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮৮৮ টাকা নির্ধারণ করেছিল। সে সময় অন্যান্য ক্যারেটের দাম ছিল- ২১ ক্যারেট স্বর্ণের দাম প্রতি ভরি ১ লাখ ৬৯ হাজার ৮০৫ টাকা। ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের দাম প্রতি ভরি ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫৪৩ টাকা। সনাতন পদ্ধতি স্বর্ণের দাম প্রতি ভরি ১ লাখ ২০ হাজার ৫১২ টাকা। এই দাম ২৩ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছিল।
চলতি বছরের স্বর্ণের দাম ওঠানামা
২০২৫ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত দেশে ২৬ বার স্বর্ণের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। এসময় ১৯ বার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ৭ বার দাম কমানো হয়েছে। ২০২৪ সালে মোট ৬২ বার দাম সমন্বয় হয়েছিল, যার মধ্যে ৩৫ বার দাম বেড়েছিল, আর ২৭ বার কমেছিল। তখন রুপার দাম একই রয়েছে। স্বর্ণের দামে পরিবর্তন এলেও রুপার দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বর্তমানে দেশের বাজারে রুপার দাম ২২ ক্যারেট রুপা প্রতি ভরি ২ হাজার ৮৪৬ টাকা, ২১ ক্যারেট রুপা প্রতি ভরি ২ হাজার ৭১৮ টাকা, ১৮ ক্যারেট রুপা প্রতি ভরি ২ হাজার ৩৩৩ টাকা
সনাতন পদ্ধতি রুপা প্রতি ভরি ১ হাজার ৭৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
দেশের বাজারে স্বর্ণের দামের এ অনুপাতিত বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে। ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা আগামীতে স্বর্ণের বাজারের অস্থিরতার ওপর নজর রাখছেন।
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি বাণিজ্য যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয় এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা অব্যাহত থাকে, তাহলে স্বর্ণের দাম আরও নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে। বাংলাদেশের বাজারেও এই প্রভাব পড়তে পারে, এবং স্বর্ণের দাম আরও বাড়তে পারে।
এপ্রিল মাসে বিশ্ববাজার ও বাংলাদেশের বাজারে স্বর্ণের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, মুদ্রাস্ফীতি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের শুল্ক নীতি। ভবিষ্যতে এই প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে, যা স্বর্ণকে একটি নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বর্ণ একটি লাভজনক বিনিয়োগ হতে পারে। তবে, বাজারের ওঠানামা সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সময়মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম যখন ৩ হাজার ৫০০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছিল, তখন কিছুটা পতন ঘটলেও বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যতে স্বর্ণের দাম পুনরায় বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন। যদি মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পায় এবং শ্রমবাজারে সংকট দেখা দেয়, তবে স্বর্ণের দাম আবারও নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে।
Leave a Reply