আজ ১ মে শ্রমিক দিবস। নানা প্রতিপাদ্যে, মিছিলে-স্লোগানে, র্যালিতে, সভা-সমাবেশে, সিম্পোজিয়ামে প্রতিবছরই দিবসটি পালিত হয়; শোনা যায় বক্তৃতার ফুলঝুরি। কিন্তু শ্রমিকের ভাগ্য বদলায় না। যাদের শ্রমে-ঘামে দেশের চাকা ঘোরে, তাদের ভাগ্যের চাকা কিন্তু ঘোরে না, থমকে থাকে। খেয়ে-পরে স্বাচ্ছন্দ্যে বাঁচার মতো সামর্থ্য তাদের তৈরি হয় না। শ্রমিকের অধিকার আদায়ে যে দিবস, সেই দিবসেও বরং রিকশাচালকসহ সকল শ্রেণির দিনমজুরের আয় আরও কম হয়, টান পড়ে পেটে। ন্যায্য মজুরি পাবেন, তাদের অধিকার বাস্তবায়ন হবে, সেই আশায় বুক বাঁধতেও ভুলে গেছেন মেহনতি এসব মানুষ।
শ্রমিকরা জানিয়েছেন, তাদের প্রতিটি মুহূর্তই শোষণের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়। ন্যায্য মজুরির অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। এর মধ্যে আবার নারী-পুরুষের বৈষম্যও রয়েছে। সমাজব্যবস্থা এমন আকার ধারণ করেছে যে, মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে যে, পুরুষের তুলনায় নারীরা কাজ কম করে। এ কারণে পুরুষের তুলনায় নারীদের মজুরি কম দিতে হবে। এমন ধারণা নিয়ে পুঁজিবাদী সমাজ গড়ে উঠেছে। ঘরে-বাইরে সব জায়গাতেই বৈষম্যের শিকার নারী শ্রমিকরা। এখনও সমমজুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি; উপরন্তু আছে পদে পদে হয়রানি, গ্লানি।
শ্রমিক নেতা জলি তালুকদার আমাদের সময়কে বলেন, শ্রমজীবী নারীরা ঘরে-বাইরে বৈষম্যের শিকার। কোথাও তাদের স্বস্তি নেই। এত বছরেও নারী-পুরুষের সমমজুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনও শ্রমিকরা দুঃখে-কষ্টে জীবন পার করছেন।
সারাবিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পালন করা হয় মে দিবস। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা রোজ আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ওই দিন অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে তাদের জীবন দিতে হয়। এর পর থেকে দিনটি ‘মে দিবস’ হিসেবে বিশ^ব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, মহান মে দিবস পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমিমশ্রেণির আন্তর্জাতিকভাবে সংহতি ও ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার প্রকাশের দিন। মে দিবস প্রতিষ্ঠার ১৩২ বছরেরও বেশি সময় পরে শ্রম মজুরি, কর্মঘণ্টা ও শোভন কর্মের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হচ্ছে। আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক- কোনো ক্ষেত্রেই মর্যাদা বা অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হয়নি। আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষ এ দিবসে এখনও তাদের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন করে আসছে। এখনও তারা শ্রমের ন্যায্য মজুরি ও ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত। নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সমকাজে সমমজুরি থেকে তারা অনেকটাই বঞ্চিত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৮৪ সালে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) ইতিহাস সৃষ্টিকারী শ্রমিক আন্দোলন এর মধ্যে অন্যতম। তখন স্কপের ডাকে ২৪ ঘণ্টার সর্বাত্মক শ্রমিক ধর্মঘট সারা দেশকে অচল করে দিয়েছিল। তখন সামরিক সরকার বাধ্য হয়েছিল স্কপের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি করতে। এ চুক্তিতে শ্রমআইনে কিছু সংশোধন করা হয়েছিল, গঠন করা হয়েছিল নতুন মজুরি কমিশন। শ্রমিকদের বোনাসের দাবিরও স্বীকৃতি মিলেছিল। তবে বিগত দুই দশক দেশে গণতন্ত্র থাকলেও শ্রমিকশ্রেণির জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি।
এদিকে শ্রমআইনের ব্যাপক পরিবর্তন আসছে বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আইনটা করে দিতে চাই। আমার ইচ্ছা আছে আমি থাকতে থাকতে একটা শ্রমআইন পাকাপোক্ত করে দেওয়া। উপদেষ্টা বলেন, শ্রমআইন নিয়ে পরে আলোকপাত করব। আমি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) থেকে ফিরে এসে বসতে পারিনি। শ্রমআইনে অনেক পরিবর্তন আসছে। এখনও পাকাপোক্ত হয়নি, তবে অনেক পরিবর্তন আছে। আমাদের আলোচনা হয়েছে। যেসব প্রস্তাব আমরা দিয়েছি, যেগুলো আমরা একসেপ্ট করেছি, সেগুলো আইএলও-কে বলা হয়েছে। সেগুলো চূড়ান্ত করতে হবে। কবে নাগাদ আমরা আইনটা পাব- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি বলব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমার তো একটা ইচ্ছা আছে যে, আমি থাকতে থাকতে একটা শ্রমআইন পাকাপোক্ত হোক।
এদিকে গতকাল কর্মজীবী নারীর (কেএন) উদ্যোগে এবং অক্সফাম-ইন বাংলাদেশের সহযোগিতায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মহান মে দিবস ২০২৫ উপলক্ষে ‘তৈরি পোশাকশিল্পের ভ্যালু চেইনে কর্মরত গৃহভিত্তিক (হোম-বেজড) শ্রমিকদের শ্রমআইনের সকল শ্রম-অধিকারপ্রাপ্তি নিশ্চিত কর’- এই প্রতিপাদ্য নিয়ে মানববন্ধন ও শ্রমিক সমাবেশ হয়।
কেএনের সহ-সভাপতি শাহিন আক্তার পারভীনের সভাপতিত্বে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতীয় শ্রমিক জোট বাংলাদেশের সভাপতি সাইফুজ্জামান বাদশা। তিনি বলেন, এই দেশ শ্রমিকের কষ্টে উপার্জিত অথচ শ্রমিকরা খেয়ে না-খেয়ে জীবন চালায়। তারা তাদের ন্যায্য প্রাপ্যটুকুও সঠিকভাবে পায় না। আমি আজকের সমাবেশের সকল দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করছি।
এদিকে শ্রমিকদের জীবিকার নিরাপত্তা অনিশ্চয়তা দিন দিন বাড়ছে বলে জানিয়েছেন অনেক শ্রমিক নেতা। তারা বলছেন, শ্রমজীবী মানুষের আয় দিন দিন কমে যাচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে কলকারখানা বন্ধ হচ্ছে। এখনও প্রতিদিন শ্রমিক ছাঁটাই চলছে, বেকার হচ্ছেন হাজার হাজার শ্রমিক। শ্রমিকের জীবনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নেই।
শ্রমিক দিবসে দিনমজুরের কষ্ট বাড়ে
যারা দিন আনে দিন খায়, শ্রমিক দিবসে তাদের কাজ কমে যায়। সরকারি ছুটির এ দিবসে মানুষজন রাস্তায় কম বের হয়। তাই এদিন রিকশাচালকদের আয় কমে যায়। ফলে নুন আনতে পান্তা ফুরানো মানুষগুলোর জন্য শ্রমিক দিবস বরং বাড়তি কষ্টের কারণ বলে মনে করেন শ্রমিকরা। অধিকাংশ শ্রমিক জানেনই না যে, তাদের অধিকারের জন্য একটি দিবস আছে। তেজগাঁওয়ের রিকশাচালক আব্দুস সালামের কাছে শ্রমিক দিবসের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই দিবস দিয়ে আমরা কী করমু। আমাদের তো প্যাডেল না চললে পেটে ভাত যাবে না।’
Leave a Reply